শামস শামীম ::
পাহাড়ি ঢল থেকে সুনামগঞ্জের ১৫টি হাওরের ফসল রক্ষায় সরকার স্থায়ী ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করছে। প্রায় ১৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এসব বাঁধ তৈরিতে ব্যয় হবে প্রায় ২৫৬ কোটি টাকা। পানি উন্নয়ন বোর্ড ‘বন্যা ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠন, জরুরি সহায়তা প্রকল্প’ থেকে এই কাজ বাস্তবায়ন শুরু করছে। চলতি বছরের জুন মাসে এই প্রকল্প শেষ হবার কথা। তবে এই প্রকল্পে কেবল বাঁধ নির্মাণই নয় হাওরাঞ্চলে ফ্লাড ফিউজ নির্মাণ, নদী তীর প্রতিরক্ষা, রেগুলেটর নির্মাণ ও সংস্কার, ভিলেজ ফ্লাডফর্ম নির্মাণ ও বৃক্ষ রোপণ কার্যক্রম রয়েছে। সব মিলিয়ে এই প্রকল্পে ব্যয় হবে প্রায় ৪৬০ কোটি টাকা। তবে হাওরের ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে প্রাধান্য দিয়ে স্থানীয় সুবিধাভোগী ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ও মতামতে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার দাবি জানিয়েছেন হাওরাঞ্চলের পরিবেশবিদরা। না হলে এই প্রকল্পের সুফল মিলবেনা বলে মনে করছেন তারা। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, দুটি পওর বিভাগের যে ১৫টি হাওরের ফসলরক্ষায় এই স্থায়ী বাঁধ নির্মিত হচ্ছে তাতে মাটির বাঁধের উপর ব্লক দিয়ে আবৃতিকরণ করা হবে। যাতে পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে না যায়। বাঁধের নির্দিষ্ট পয়েন্টে ফ্লাড ফিউজ নির্মাণ করা হবে। বাঁধের বিভিন্ন পয়েন্টে যেখানে ফ্লাডফিউজ নির্মিত হবে ফসল কাটার পর তা খুলে দেওয়া হবে পানি বের করা ও নৌ যাতায়াতের জন্য। এছাড়াও এসব বাঁধে ব্যবহার করা হবে জিও ব্যাগ। সূত্র আরো জানায়, পওর বিভাগ-২ এর আওতায়, শাল্লায় ছায়ার হাওরে দাড়াইন নদী তীরে ৩.৭ কিলোমিটার স্থায়ী ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণকাজ চলছে। এই বাঁধের মধ্যে রয়েছে ২টি ফ্লাড ফিউজ। এতে ব্যয় হবে ৪৮ কোটি টাকা। দিরাই উপজেলার ভরাম হাওরে ২.৮৬ কি.মি ফসলরক্ষা বাঁধ ও ৩টা ফ্লাড ফিউজ নির্মাণ করা হবে। এতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৪৬ কোটি টাকা। শান্তিগঞ্জ উপজেলার খাই হাওর ও জামখোলা হাওরে ২.৪ কিলোমিটার বাঁধ ও ২টি ফ্লাড ফিউজ নির্মাণে বরাদ্দ রয়েছে ৪১ কোটি টাকা। পওর-২ বিভাগে প্রায় ৮.৯৬ কিলোমিটার বাঁধ ও ৭টি ফ্লাড ফিউজ নির্মিত হবে। এতে মোট ব্যয় হবে প্রায় ১৩৫ কোটি টাকা। এদিকে পওর বিভাগ-১ এর আওতায় ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্রসোনার থাল হাওরে ২ কিলোমিটার বাঁধ ও ২টি ফ্লাড ফিউজ নির্মিত হবে। এতে ব্যয় হবে ৩৮ কোটি ৫৫ হাজার টাকা। উপজেলার ধানকুনিয়া-সোনামোড়ল হাওরে ১ কিলোমিটার বাঁধ ও ১টা ফ্লাড ফিউজ নির্মিত হবে। যাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২০ কোটি টাকা। মধ্যনগর উপজেলার গুরমার হাওরে ১.৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বাঁধ নির্মাণ ১৯ কোটি ৫৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই বাঁধে কোনও ফ্লাড ফিউজ রাখা হয়নি। জামালগঞ্জ উপজেলার পাগনা ও মহালিয়া হাওরে ৭০০ মিটার বাঁধ ও ২টি ফ্লাড ফিউজ নির্মিত হবে। এতে ব্যয় হবে ১৫ কোটি ৬৭ লক্ষ টাকা। শনির হাওরে (জামালগঞ্জ অংশে) ৯৫০ মিটার বাধ ও ১টা ফ্লাড ফিউজ নির্মাণে বরাদ্দ রয়েছে ১৬ কোটি ৬৬ লক্ষ। তাহিরপুর উপজেলার মাটিয়ান হাওরে ১.৮ কিলোমিটার বাঁধ ও ১টা ফ্লাড ফিউজ নির্মাণে ব্যয় হবে ৩৬ কোটি ৬২ লক্ষ টাকা। এছাড়া বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওর ও আঙ্গারুলি হাওরে ১.৭ কিলোমিটার বাঁধ ও ২টা ফ্লাড ফিউজ নির্মাণের কথা রয়েছে। এতে ব্যয় হবে ২৭ কোটি ৩৮ লক্ষ টাকা। পওর-১ বিভাগে ৯.৪৫ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ ও ৮টি ফ্লাড ফিউজ নির্মাণে মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১২১ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে দরপত্র আহ্বান করে কার্যাদেশ দিয়ে বিভিন্ন হাওরে কাজও শুরু হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বাঁধের কাছাকাছি তৈরি করা হচ্ছে ব্লক। প্রস্তুত করা হচ্ছে ফ্লাড ফিউজ নির্মাণ ব্যবস্থাপনা। সংশ্লিষ্টরা জানান, এই প্রকল্পে স্থায়ী ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মিত হলে হাওরে ফসলডুবির ঘটনা কমবে। পাহাড়ি ঢলের প্রথম ধাক্কাতে ফসলহানির আশঙ্কা থাকবেনা। তবে স্থায়ী বাঁধের কারণে হাওরের প্রাণ ও প্রকৃতির ক্ষতি হবে এবং মৎস্য উৎপাদনে প্রভাব পড়বে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সুনামগঞ্জ পরিবেশ আন্দোলনের নেতা সাইফুল আলম সদরুল বলেন, হাওরের ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অন্যরকম। একদিকে উন্নয়ন করলে আরেকদিকে প্রতিক্রিয়া হয়। আমাদের বাঁধও প্রয়োজন, প্রয়োজন নদী খনন ও বনায়ন। একটাকে বাদ দিয়ে আরেকটা করলে প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে। তাই পরিবেশবিদ, কৃষিবিদ, মৎস্য বিজ্ঞানী, প্রকৌশলীহ স্থানীয় সুবিধাভোগীদের মতামতের ভিত্তিতে প্রকল্প এগিয়ে নিতে হবে। না হলে উপকারের চেয়ে আখেরে ক্ষতিই হবে। হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, হাওরে গ্রামগুলোতে এক সময় ব্লকের রাস্তা নির্মিত হতো। এখন এই রাস্তা বিপজ্জনক হয়েছে। কেউ ব্যবহার করেনা। এটাও একসময় স্থায়ী হবেনা হাওরের ভূমি বৈশিষ্ট্যের কারণেই। এই বাঁধের অবস্থাও একসময় এমন হবে। তিনি বলেন, শুধু স্থায়ী বাঁধ দিয়ে পানি আসা বন্ধ করলেই হবেনা, বাঁধ খুলে পানিও ঢুকাতে হবে। হাওরের জনপ্রিয় নেতা ও তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, একফসলি বোরোর উপরই আমাদের হাওরবাসীর ভাগ্য নির্ধারিত হয়। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দাবি স্থায়ী বাঁধের। তবে যত্রতত্র বাঁধ না দিয়ে স্থানীয় অভিজ্ঞ কৃষকদের মতামতের ভিত্তিতে কাজটি বাস্তবায়ন করতে হবে। কৃষকের সঙ্গে হাওরের প্রকৃতির স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়েই কাজ করতে হবে। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌলী-১ মামুন হাওলাদার বলেন, ব্লক পদ্ধতিতে স্থায়ী ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ শুরু হয়েছে। তৈরি হচ্ছে ব্লক। প্রতিটি বাঁধেই পানি বের করার জন্য ফ্লাড ফিউজ রয়েছে। এছাড়াও বৃক্ষ রোপণও করা হবে। এতে হাওরের ফসল সুরক্ষিত হবে। হাওরের ক্ষতি না করেই বিশেষজ্ঞ নকশা করে কাজটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। তাছাড়া হাওরে প্রতি বছর মাটির সমস্যার কারণে ফসলরক্ষা বাঁধ দিতে যে সমস্যা হচ্ছে তারও সমাধান হবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
প্রকল্প ব্যয় ২৫৬ কোটি টাকা,হাওরের ভূপ্রকৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি
১৫ হাওরে নির্মাণ হচ্ছে স্থায়ী ফসলরক্ষা বাঁধ
- আপলোড সময় : ৩০-০১-২০২৫ ১২:১৪:২১ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ৩০-০১-২০২৫ ১২:১৫:১৩ পূর্বাহ্ন
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ